সোমবার, ২০ জুন, ২০২২

সনাতন ধর্মের প্রধান প্রধান ধরমগ্রন্থসমূহ যাহা সমৃদ্ধ করেছে সনাতন ধর্মকে

 








প্রত্যেক ধর্মেরই নিজস্ব ধর্মগ্রন্থ আছেধর্মগ্রন্থের অপর নাম শাস্ত্র। অন্যান্য ধর্মের সাথে তুলনা করলে দেখা যায় হিন্দু শাস্ত্রের সংখ্যা অগণিত। তার কারণ হল হিন্দুধর্ম অত্যন্ত প্রাচীন। তাই একে সনাতন ধর্ম বলা হয়।হিন্দুধর্মের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় পাণ্ডুলিপি ঐতিহাসিক সাহিত্যের সংকলন নিয়েই আমাদের হিন্দু ধর্মগ্রন্থ কয়েকটি হিন্দু ধর্মগ্রন্থ একাধিক সম্প্রদায়ে স্বীকৃত। এগুলিকেই বৃহত্তর অর্থে হিন্দুশাস্ত্র বলা হয়ে থাকে। ঈশ্বরের স্বরূপ, জীবের সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্ক, ঈশ্বর প্রাপ্তির উপায় প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয় শাস্ত্র থেকেই জানা যায়। হিন্দু শাস্ত্রের সংখ্যা অনেক হওয়াতে বিভিন্ন সত্যদ্রষ্টা ঋষি ঈশ্বরপ্রাপ্তির বিভিন্ন উপায়ের কথা বলেছেন। প্রত্যেক ধর্মে একাধিক ধর্মগ্রন্থ বা শাস্ত্র থাকলেও তার মধ্যে একখানা সিদ্ধশাস্ত্র থাকে। হিন্দুধর্মের সিদ্ধশাস্ত্র হল বেদ। 

 

বৈদিক যুগের হিন্দু ঋষিগণ বেদকে ভিত্তি  করে যুগপোযোগী কতকগুলি শাস্ত্র রচনা করেন। সেগুলো হলঃ স্মৃতিসংহিতা, ইতিহাস, পুরাণ, আগম এবং ষড়-দর্শন। এগুলি উল্লেখযোগ্য হিন্দুধর্ম গ্রন্থ বলে পরিচিত।

 সনাতন ধর্মের ধর্মগ্রন্থগুলোভাগে বিভক্ত-শ্রুতি স্মৃতি। শ্রুতি হল বেদ(৪ টি),বেদাঙ্গ(৬ টি),বেদান্ত/উপনিষদ (১২টি) স্মৃতিভাগে বিভক্তসংহিতা পুরাণ।

হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলির দুটি ঐতিহাসিক শ্রেণীবিন্যাস হল: ‘শ্রুতি যার অর্থ শোনা হয়েছেত  স্মৃতি যা মনে রাখা হয়েছে।শ্রতিশাস্ত্রগুলি সর্বোচ্চ প্রামাণিক ধর্মগ্রন্থ। এগুলি সেই প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ যেগুলিকেঅপৌরুষেয়’ (স্বয়ং ঈশ্বরের মুখনিঃসৃত) মনে করা হয়। এগুলিই হিন্দুধর্মের কেন্দ্রীয় ধর্মগ্রন্থ।

নির্দিষ্ট লেখক কর্তৃক রচিত ধর্মগ্রন্থগুলিস্মৃতিপর্যায়ভুক্ত। শ্রুতিশাস্ত্রের তুলনায় স্মৃতিশাস্ত্রের গুরুত্ব কম। স্মৃতিশাস্ত্র বৈচিত্র্যপূর্ণ এক বিশাল শাস্ত্র-সংকলন। বেদাঙ্গ, হিন্দু মহাকাব্য, ধর্মসূত্র, হিন্দু দর্শন, পুরাণ, কাব্য এই ধারার অন্তর্গত।

আগে হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলি মুখে মুখে রচিত হত মনে রাখা হত এবং মুখে মুখেই গুরুশিষ্য-পরম্পরায় এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রচলিত ছিল। এক সহস্রাব্দ পর এগুলি পাণ্ডুলিপি আকারে লিখিত হয়।] হিন্দুশাস্ত্র মুখে মুখে সংরক্ষণ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রচলনের এই প্রথা আধুনিক যুগেও প্রচলিত আছে

 

প্রধান  হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থের নামঃ

 

বেদ

বেদ হল প্রাচীন ভারতে লিপিবদ্ধ একাধিক গ্রন্থের একটি বৃহৎ সংকলন। ছান্দস্ ভাষায় রচিত বেদই ভারতীয় সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন এবং সনাতন ধর্মের সর্বপ্রাচীন পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। সনাতনীরা বেদকেঅপৌরুষেয়” (“পুরুষ বা লোকদ্বারা কৃত নয়, অলৌকিক) এবংনৈর্বক্তিক রচয়িতা-শূন্য” (যা সাকার নির্গুণ ঈশ্বর-সম্বন্ধীয় এবং যার কোনও রচয়িতা নেই) মনে করেন। আর্ষ শাস্ত্র অনুযায়ী পরব্রহ্মই সৃষ্টির আদিতে মানব হিতার্থে বেদের জ্ঞান প্রকাশ করেন। সর্বপ্রথম অগ্নি, বায়ু, আদিত্য অঙ্গিরা এই চার ঋষি চার বেদের জ্ঞান প্রাপ্ত হন। এবং পরবর্তিতে তাঁরা অন্যান্য ঋষিদের মাঝে সেই জ্ঞান প্রচার করেন এবং অলিপিবদ্ধভাবে পরাম্পরার মাধ্যমে তা সংরক্ষিত হয়ে এসেছে। আর্যসমাজের প্রতিষ্ঠাতা মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী এই চার ঋষিকে শরীরধারী মানুষ বলেছেন। পুস্তক আকারে প্রাপ্ত বেদ আধুনিক হলেও এর জ্ঞানকে শাশ্বত বলে অনেক পণ্ডিতই স্বিকার করেন। পাশ্চাত্যের অনেক গবেষক ভাষাগত রচনাশৈলি, প্রত্নতাত্তিক প্রমাণাদির উপর নির্ভর করে বেদের রচনাকাল ১৫০০ থেকে ৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ হিসাবে ধারণা করেন। হিন্দুধর্মের প্রসিদ্ধশাস্ত্র গ্রন্থ বেদ বেদের অপর নাম শ্রুতি। বেদ চার প্রকার। যথা- ) ঋক্বেদ, ) সামবেদ, ) যজুর্বেদ এবং ) অথর্ববেদ। ঋষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ণ বেদব্যাস এই বেদের বিভাগ কর্তা।

প্রত্যেক বেদের দুটি অংশ তা হলঃ ) সংহিতা (সংহিতায় আছে মন্ত্র) এবং ) ব্রাহ্মণ (ব্রাহ্মণে আছে তার অর্থ ব্যবহার)

বেদে মোট মন্ত্র সংখ্যা ২০৩৭৯টি।

 

বেদাঙ্গ

বেদের মর্ম যথার্থভাবে উপলব্ধি করার জন্য বেদের ছয়খানা অবয়বগ্রন্থ অধ্যায়নের প্রয়োজন। এই অবয়ব গ্রন্থগুলিকে বলা হয় বেদাঙ্গ। বেদাঙ্গ শাস্ত্রগুলো হলঃ ) শিক্ষা, ) কল্প, ) ব্যাকরণ, ) নিরুক্ত, ) ছন্দ এবং ) জ্যোতিষ।

 

উপবেদ

মূল বেদের সহকারী গ্রন্থ বলে এদেরকে উপবেদ বলে। যথাঃ- ) আয়ুর্বেদ (ভেষজশাস্ত্র), ) ধনুর্বেদ (অস্ত্রবিদ্যা), ) গন্ধর্ববেদ (সঙ্গীত বিদ্যা) এবং ) স্থাপত্যবেদ (কৃষিবিদ্যা)

 

উপনিষদ

উপনিষদ হিন্দুধর্মের এক বিশেষ ধরনের ধর্মগ্রন্থের সমষ্টি এই বইগুলিতে হিন্দুধর্মের তাত্ত্বিক ভিত্তিটি আলোচিত হয়েছে উপনিষদ্গুলিতে সর্বোচ্চ সত্য স্রষ্টা বা ব্রহ্মের প্রকৃতি এবং মানুষের মোক্ষ বা আধ্যাত্মিক মুক্তি লাভের উপায় বর্ণিত হয়েছে উপনিষদ্গুলি মূলত বেদ-পরবর্তী ব্রাহ্মণ আরণ্যক অংশের শেষ অংশে পাওয়া যায় এগুলি প্রাচীনকালে গুরু-শিষ্য পরম্পরায় মুখে মুখে প্রচলিত ছিল। উপনিষদ হল বেদের সারাংশ তাই একে বেদান্তও বলা হয়। উপনিষদের সংখ্যা অনেক। বর্তমানে ১১২ খানা উপনিষদের নাম জানা গেছে। ১১২ খানা উপনিষদের মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য হলঃ ) বৃহদারণ্যক, ) শ্বেতাশ্বতরো, ) ছান্দোগ্য, ) ঐতরেয়, ) তৈত্তিরীয়, ) ঈশ, ) কেন, ) কঠ, ) প্রশ্ন, ) মন্ডুক এবং ) মান্ডুক্য প্রভৃতি।

 

স্মৃতি-সংহিতা

যা যা স্মৃত হয়েছে তাই স্মৃতি। স্মৃতি শব্দের অর্থ স্মরণ। স্মৃতি-সংহিতা পাঠ করে হিন্দুরা জানতে পারে মানুষের ধর্ম-কর্ম কি। আমাদের বিশখানা স্মৃতি-সংহিতা রয়েছে। এদের মধ্যে তিনখানা স্মৃতি-সংহিতা প্রধান প্রসিদ্ধ। তা হলঃ ) মুন-স্মৃতি, ) যাজ্ঞবল্ক-স্মৃতি এবং ) পরাশর-স্মৃতি।

 

মহাভারত রামায়ণঃ মহাভারত রামায়ণ দুটি হিন্দুধর্মীয় গ্রন্থের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই গ্রন্থ দুটি ইতিহাসে মহাকাব্য হিসাবে পরিগণিত হয়ে রয়েছে। বেদের শাশ্বত সনাতন সত্যগুলি ঐতিহাসিক কথা-কাহিনীর মধ্য দিয়ে জনসমাজে প্রচার করা এই ধর্মগ্রন্থ দুটির মুখ্য উদ্দেশ্য।





 

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা

মহাভারতের ভীষ্মপর্বের অন্তর্গত সুপ্রসিদ্ধ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা মহাভারতের অন্তর্গত হলেও স্বতন্ত্র ধর্মগ্রন্থরূপে হিন্দু সমাজে সমাদৃত।চতুর্বেদের সার উপনিষদ, উপনিষদের সার এই গীতা ধর্মের গুঢ়তত্ত্ব গীতায় প্রকাশিত। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ প্রাক্কালে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হিন্দুধর্মের সারতত্ত্ব তৃতীয় পান্ডব অর্জুনের কাছে ব্যাখ্যা করেন।




 

পুরাণ

যা পুরাতন তাই পুরাণ। বেদের পুরাতন দার্শনিকতত্ত্ব সাধনতত্ত্ব নানাভাবে উপাখ্যানের মাধ্যমে পুরাণ প্রচার করেছে বলে একে পুরাণ বলা হয়। পুরাণে সৃষ্টিতত্ত্ব, ইতিহাস, দার্শনিকতত্ত্ব, সাধন প্রণালী প্রভৃতি নানাবিধ বিষয় পুরাণে আলোচিত হয়েছে। পুরাণের পাঁচটি লক্ষণ আছে। যথা- ) সর্গ, ) প্রতিসর্গ, ) বংশ, ) মন্বন্তর এবং ) বংশানুচরিত। পুরাণকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথাঃ- ) মহাপুরাণ এবং ) উপপুরাণ।



 


মহাপুরাণ

হিন্দুশাস্ত্রে আঠারোটি মহাপুরাণ রয়েছে। এই আঠারোটি পুরাণের মধ্যে সাতটি পুরাণ উল্লেখযোগ্য। যথাঃ ) বিষ্ণুপুরাণ, ) পদ্মপুরাণ, ) বায়ুপুরাণ, ) স্কদ্ধপুরাণ, ) মার্কন্ডেয়পুরাণ এবং ) ভাগবত পুরাণ প্রভৃতি।

 

ভাগবতপুরাণ

ভাগবত পুরাণকে আবার দুই ভাগে ভাগ করেছেন। যথাঃ ) দেবী ভাগবত (শ্রীদুর্গার শক্তি মাহাত্ম্য বর্ণিত) এবং ) শ্রীমদ্ভাগবত বা বিষ্ণু ভাগবত (শ্রীকৃষ্ণের শক্তি মাহাত্ম্য বর্ণিত)

 

উপপুরাণ

মহাপুরাণের মতো উপপুরাণও আঠারো-খানা রয়েছে। যথাঃ ) আদি, ) নৃসিংহ, ) বায়ু, ) শিবধর্ম, ) দুর্বাসঃ, ) বৃহন্নারদীয়, ) নন্দিকেশ্বর, ) উশনঃ, ) কপিল, ) বরুণ, ) শাম্ব (এটি যাচাই করে নিবেন) ) কালিকা, ) মহেশ্বর, ) দেবী, ) ভার্গব, ) বশিষ্ট ) পরাশর এবং ) সূর্য ইত্যাদি।

 

চন্ডি

চন্ডি মার্কন্ডেয় পুরাণের অন্তর্ভুক্ত হলেও প্রকৃতি পক্ষে একটি স্বতন্ত্র হিন্দু ধর্মগ্রন্থ রূপে স্বীকৃত। জগৎ জননী মা দুর্গার আগমনে অর্থাৎ দুর্গা পূজার সময় পাঠ করা হয়। এছাড়াও গীতা মত চন্ডি হিন্দুদের নিত্য-পাঠ্য বিষয়।






আগম শাস্ত্র

হিন্দুধর্মে আগম শাস্ত্রের সংখ্যা অনেক। আগম শাস্ত্র হল দেবদেবীর পূজা-অর্চনার পদ্ধতি বিষয়ক সম্প্রদায়ক গ্রন্থ। হিন্দুধর্মের তিনটি সম্প্রদায় রয়েছে। যথাঃ ) শৈব, ) বৈষ্ণব এবং ) শাক্ত। তিনটি সম্প্রদায়ের নিজ নিজ আগম শাস্ত্র রয়েছে। গুলিকে যথাক্রমে শৈবাগম (শিব), বৈষ্ণাবগম (বিষ্ণু) এবং শাক্ত্যগম (মহামায়া) বলা হয়। সম্প্রদায়ের কাছে শিব, বিষ্ণু মহামায়া- হল পরমতত্ত্ব।

 

ষড়দর্শন

ষড়দর্শন হল ছয়টি দর্শন বা শাস্ত্র। তা হলঃ ) সাংখ্য-দর্শন, ) যোগ-দর্শন, ) ন্যায়, ) বৈশেষিক, ) পূর্ব-মীমাংসা, এবং ) উত্তর-মীমাংসা বা বেদান্ত-দর্শন।

 

এছাড়াও বিভিন্ন শাস্ত্রের দুর্বোধ্যতা দূর করার জন্য অনেক ভাষ্যকারগণ বহু টীকা, টিপ্পনী, বার্তিক রচিত করেছেন। এদের মধ্যে ব্রহ্মসূত্রের উপর দুখানা উল্লেখযোগ্য ভাষ্য হলঃ শঙ্করাচার্যেরশারীরিক ভাষ্যআর রামানুজেরশ্রীভাষ্য অতপর গোবিন্দনন্দ শারীরিক ভাষ্যের উপররতনপ্রভানামে একটি টীকা রচনা করেন।

 

 

সোর্সঃ

·         সনাতন হিন্দু ধর্ম কী এবং কেন; সৈজন্যে বাংলাদেশ সেবাশ্রম

·         উইকিপিডিয়া

 

1 টি মন্তব্য: